30 মে 2024 বৃহস্পতিবার।আমি তখন হাজিগঞ্জে, চাঁদপুর পড়াশোনার পাশাপাশি ভিভো শৌরুম এর জব করতাম।
মাসের শেষ, কয়দিন পর একাউন্টে স্যালারি ঢুকবে তার উপর পরের মাসে কোরবানির ঈদ। সারাদিন এইসব বিষয়ে চিন্তা ভাবনা ছিল।
ছোট ভাই শাকিলের দোকানে আসরের আগে দুইজন লোক এসে একপাতা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ কিনার বাহানায় কৌশলে একটি কালো গাড়িতে তুলে নেয়।
শাকিলকে তুলে নিয়ে গেছে এটা আমাদের জানা ছিল।সবার ধারণা ছিল হয়তো পারিবারিক কোন সমস্যার কারনে থানা থেকে এসে নিয়ে গেছে। তাই এই নিয়ে বেশি একটা চিন্তা করার কিছু মনে করি নি।
মাগরিবের নামাজের পর শৌরুমে এসে মাত্র বসলাম। দুইজন লোক সিভিল ড্রেসে শৌরুমে এসে ঢুকলো। আমি কাস্টমার ভেবে সালাম দিলে তারা মুসাফা করতে হাত এগিয়ে দেয়। মুসাফা করার সময় ওনাদের একজন আমার নাম জিজ্ঞাসা করল। আমি তখন বুঝতে বাকি রইল না তারা আইন-শৃঙ্খলার লোক কারন কাস্টমার কখনোই বিক্রেতারা নাম জিজ্ঞাসা করবে না। তারা খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল। স্যার 5 মিনিট কথা বলবে বলে, তাদের সাথে আসতে বলে। আমিও মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে তাদের সাথে যেতে লাগলাম।যাওয়ার সময় কলিগকে হাতের ইশারায় সিসি ক্যামেরা ফুটেজ রেখে দিতে বলি।
গাড়িতে তুলে সাথে সাথেই তারা আমার ফোন নিয়ে যায়, আর হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে ফেলে। তারপর সবার পিছনের সিটে তিন জনকে একসাথে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে রাখে। আমরা বার বার অনুরোধ করেছিলাম যে আমাদের পরিবারকে যেনো জানিয়ে দেওয়া হয়। ওনারা অনুরোধ রাখে নি। গাড়ি কচুয়া বিশ্বরোড হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। এর মধ্যে কচুয়া গাড়ি থামিয়ে আমাদের তিন জনকে রাতের খাবার কিনে দেওয়া হয়। কিন্তু খাবার তো গলা দিয়ে নামে না। অনেক কষ্ট করে মাংশটুকু খেয়ে বাকিগুলো রেখে দেই।
দাউদকান্দিতে টোল দেওয়ার সময় আমাদের গাড়িকে পিছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা দেয়। সবার পিছনের সিটে থাকায় ভালোই ভয় পেয়েছিলাম। কিছুক্ষন পর ঢাকায় ঢুকলাম।যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার এ তখন ফাঁকা,হাতে ঘড়ি ছিল, সাড়ে বারোটা বাজে তখন। ঘুমে চোখ ভারি হয়ে আসছিল,কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানাই ছিল না। চোখ খুলল যখন তখন আমারা মিন্টু রোডের কাউন্টার টেরোরিজম এর কার্যালয়ে এর সামনে
গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাদের হ্যান্ডকাফ খুলে তিন জনকে একসাথে একটি সেলে রাখা হয়। ওখানে মোট 5 টা সেল ছিল।সেলের ভিতর টয়লেট, টয়লেট গুলোর দেয়াল 3/4 ফুট হবে।কত হাজার বছর ধরে যে টয়লেটি পরিস্কার করা হয় নি তা দেখলেই বুঝা যায়। সেলে কোন সিলিং ফ্যান নেই। নেই কোন আলো বাতাস ঢুকার সুযোগ। ফজরের নামাজের পর ঘুমাতাম, এরপর ঘুম ভাংতো সকালের নাস্তা হিসেবে দেওয়া খিচুড়ির উৎকট গন্ধে। খাবার গুলো এতো বাজে নিতান্তই বেঁচে থাকার জন্য খেতে হতো।
৩১ মে তারিখ থেকে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সকালে আমাদের প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেওয়া হয়। উম্মাহ নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্ক আছে কি না, তাদের সাথে টাকা পয়সা লেনদেন হয় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন। একজন অফিসার বললেন, “উত্তর গুলো ঠিকমতো দাও, প্রশ্ন গুলো আমেরিকা থেকে করা হয়েছে”। ওখানে থাকা কালীন এমন কি দিন নেই আমরা অনুনয় বিনয় করেছি শুধু পরিবারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য।
১ জুন আমাদের পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফোনের কন্টাক লিস্টের পরিচয়, টাকা-পয়সার হিসাব,কোন দল করি, ইসলাম প্রেকটিস করি কবে থেকে…..
এর মধ্যে ২ নম্বর টিম এর এডিসি জানায় ,সোশ্যাল মিডিয়াতে মোটামুটি আমাদের নিয়ে সবাই সরব। কম্পিউটার ক্রিন আমাদের দিক ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন পোস্ট।
২ জুন আমাদের CMM কোটে উঠানো হয়। কি এক দুঃসহ স্মৃতি।গরুর মতো পিছন দিয়ে হাত বেঁধে উঠানো হয়, মনে হচ্ছে কোন কোরবানির গরু।কোর্টে উঠানো পর আমাদের ১১দিনের রিমান্ড চাওয়া হয় , মেজিস্ট্রেট ৩দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
৩ দিনের রিমান্ডে আমাদের কিছুই করা হয় নি। আসরের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিত মাগরিবের পর সেলে ফেরত দিয়ে যেত সেলে।
প্রশ্ন আসতে পারে,
১/ তোমাদের শুধু শুধু ধরবে কেন?
২/নিশ্চয়ই কোন সমস্যা ছিল?
আমাদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ছিল আমাদের “দ্বিন ইসলাম ফাউন্ডেশন” নামে। গত রোজায় সময় আমারা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৮লক্ষ ৫০ হাজার টাকার ফান্ড কালেকশন করি ফিলিস্তিনে পাঠানোর জন্য।এই ফান্ড কালেকশন করা হয় অনলাইন অফলাইন দুই মাধ্যমেই। ফিলিস্তিনের নামে টাকা সংগ্রহ করে আমারা জঙ্গি সংগঠনকে ফান্ডিং করি এই সন্দেহ আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিটিটিসিতে আমরা পূর্ণ টাকার হিসাব দিই। যাবতীয় সব ডকুমেন্ট ছিল আমাদের কাছে।
যেদিন আমাদের কোর্টে উঠাবে সেদিন আমার মন খারাপ দেখে সিটিটিসির একজন অফিসার বলেছিল, “আমাদের এখানে যে একবার ঢুকে সে নিজ পায়ে হেঁটে এখান থেকে বের হতে পারে না, তোমরা ভালো মানুষ এইজন্য তোমাদের গায়ে আমরা হাত দিই নাই।
গুম , রিমান্ডে আমাদের কোন শারীরিক কোন টর্চার করা হয় নি।তাই বলে শুকরিয়া করব। শুকরিয়া করব কিভাবে,তারা মামলা দিল। সিটির একজন বলেছিল, আমরা চেষ্টা করেছি মামলা না দিতে, কিন্তু উপর থেকে নির্দেশ ছিল”
আমাদের নামে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়। সন্ত্রাসবিরোধী মামলা সব গুলো ধারা ৬(২),৭,৮,৯,১১,১২,১৩ আমাদের সাথে লাগানো হয় যাতে করে ২/৩ বছরেও জেল থেকে না বের হতে পারি। এই সব কিছু শুধুমাত্র ফিলিস্তিনে অর্থ পাঠানোর জন্য।
মাঝে মাঝে মনে হয় মামলা না দিয়ে,যদি হাত পা ভেঙ্গে দিত তবূও এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত।
আমাদের আটক করা হয় ৩০ মে, ২০২৪ তারিখ হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর থেকে..
মামলার এজাহারে দেখানো হয় ২ তারিখ আমাদের গ্ৰেফতার করা হয় ঢাকার ওয়ারি থানার অন্তর্গত দেশবন্ধু হোটেল এর সামনে থেকে।আমরা নাকি ৭/৮ জন মিলে নাশকতার করার জন্য এসেছিলাম। তাঁরা ধাওয়া দিলে আমাদের ৩ জনকে ধরতে সক্ষম হয়। আমরা নাকি স্বীকার করেছি নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলাম এর সদস্য।
তারপর তো কেরানীগঞ্জে কাশিমপুর কারাগারে চালান, ডান্ডা বেড়ি পড়ানো, দিনের ২৩ ঘন্টা সেলে বন্ধী থাকা। কত যে দুঃসহ স্মৃতি…
আর বলতে ইচ্ছে করে না। কিছু জুলুমের প্রতিদিন রব থেকে নিব। প্রতিদান কি চাইতে পারি?
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাকে আর আমার পিতামাতাকে এই জুলুমের প্রতিদান হিসেবে ক্ষমা করে দিক।
আমার নানা ভাই। আমি আমার নানা ভাই এর জানাজা পাই নি। আমার সিরাজ ভাই ২০ জুন মারা যায়,আমি জানতে পারি নি। জানবো কিভাবে জেলে জঙ্গীদের ফোনে কথা বলা নিষেধ।
নতুন বাংলাদেশে এসব থেকে মুক্তি পাব কী?
প্রতি মাসে মাসে হাজিরা দেওয়া থেকে কি মুক্তি পাব?
মামলা থেকে অব্যাহতি মিলবে কী?
Leave a Reply