মে মাসের প্রচণ্ড গরম। ঢাকার আকাশে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
এমনই এক দিন, ২০১৫ সালের এক দুপুরে, সদরঘাটের লঞ্চ থেকে নামলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রভাষক আবুল বাশার। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। শান্ত, সাদামাটা, নিরীহ এক মানুষ। মাথায় তখনও খেলছিলো সন্তানের হাসি—যাকে তিনি রেখে এসেছেন বরিশালে; পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে। জীবনের আর দশটা দিনের মতই মনে হচ্ছিলো এই দিনটিকেও। অথচ সেটিই হয়ে দাঁড়ালো তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কালরাত্রির সূচনা।
ঘাটে নামতেই হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে নেমে এলো কয়েকজন অচেনা মানুষ।
ঠান্ডা একটি প্রশ্ন এলো “আপনার নাম আবুল বাশার?”
অবাক হলেও অভ্যাসবশত তিনি হ্যাঁ বলেছিলেন। সেই উত্তর উচ্চারণ করতেই যেন তাঁর ভাগ্যের সমস্ত দুয়ার বন্ধ হয়ে গেলো।
মুহূর্তের মধ্যে চারদিক ঘিরে ফেলা হলো। কোমরে লুকোনো অস্ত্র দেখিয়ে তারা জানালো—“আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।”
কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা স্ত্রীর সামনে থেকে আবুল বাশারকে ধরে মাইক্রোবাসে তুললেন। গাড়িতে তুলেই কালো কাপড়ে চোখ বেধে ফেলা হলো। কেউ একজন হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। আর মাথা মাটিতে ঠেসে ধরলো। পৃথিবী মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেলো।
এরপর শুরু হলো এক অনন্ত যাত্রা—যেখানে নেই আলো, নেই দয়া, নেই মানবিকতা।
তিনি পৌঁছালেন সেই কুখ্যাত জায়গা, আয়নাঘরে। উত্তরা র্যাব-১ এর প্রধান কার্যালয়ের ভেতরের সেই টিএফআই বা Task-Force Interogation সেলের মধ্যে।
প্রথম রাত থেকেই শুরু হলো ভয়াবহ নির্যাতন। পৌঁছানো মাত্র চোখের কাপড় বদলে দেওয়া হলো। এরপর শুরু হলো এলোপাথাড়ি আঘাত।
বসতে দেওয়া হয়নি, দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শরীর ভেঙে দেওয়া হলো। কাপড় ছিঁড়ে ফেলে শুধু একটি গামছায় আবৃত করে দেওয়া হলো তাঁকে।
তারপর একসাথে কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়লো—ঘুষি, লাথি, লাঠি।
তিনি শুধু একটি প্রশ্ন করলেন—“কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে? কেন?”
উত্তরে এলো শুধু অশ্লীল গালি আর আঘাত।
কিছুদিন পর তিনি বুঝলেন—অপরাধ একটাই। তিনি শাইখুল হাদিস মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী হাফিজাহুল্লাহর আপন ছোট ভাই। ভাইয়ের মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়াগুলোর দেখাশোনা তিনি করতেন। সেই কারণেই আজ তিনি রাষ্ট্রীয় দানবের শিকার। শুধু হুজুরই নন; সারাদেশে গনগ্রেফতারের নামে যে অসংখ্য মানুষকে শেখ হাসিনা গ্রেফতার করেছিলো তার মধ্যে তাঁর ভাই-ভাতিজা সকলেই ছিলেন। আবুল বাশার ভাই সকলকেই আইনি প্রক্রিয়া মেনে জামিন করিয়েছিলেন।
সাড়ে তিন মাস আয়নাঘরের ভেতরে তাঁর কাছে জীবন মানেই ছিলো এক দীর্ঘ মৃত্যুযন্ত্রণা।
টানা দশ দিন তাঁকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। জানালার সাথে হাতকড়া লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো দিনরাত। পুরুষাঙ্গে বিদ্যুতের তার পেঁচিয়ে দেওয়া হতো ইলেক্ট্রিক শক। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করলে তারা হো হো করে হাসতো। শরীরের ভেতর থেকে রক্ত ঝরত, অথচ চিকিৎসার নামগন্ধও ছিলো না। চোখ বাঁধা থেকে কানে পচন ধরলো, দুর্গন্ধ ছড়ালো, তবু করুণা জাগলো না কারও মনে। দীর্ঘদিনের নির্যাতনে কোমর থেকে হাঁটু প্রায় পচেই গিয়েছিলো। সারা শরীরে ছোপ ছোপ কালো রক্তের দাগ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিলো প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে হিংস্র জানোয়ারগুলো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ধীরে ধীরে তিনি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলেন। এক সবল যুবককে ধ্বংস করে দেওয়া হলো আয়নাঘরের অন্ধকারে।
তারা বলতো—
“তোকে আমরা শুধু এই জন্যই ধরেছি, যেন কেউ আর এই ধরনের মামলায় জামিনের সাহস না করে।”
অবশেষে তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলো ভুয়া মামলায়। মিডিয়াতে প্রচার করা হলো—“আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড গ্রেফতার।”
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার গর্জে উঠলো—“ভয়ংকর এক জঙ্গি ধরা পড়েছে।”
কিন্তু সত্যি জানতো যারা তাঁকে চিনতো, তারা বলতো—“এমন হাসিখুশি, মজার, মিশুক মানুষ দ্বিতীয়টি নেই।”
কারাগারে গিয়েও শেষ হলো না নির্যাতন। বাড়তি কড়াকড়ির মধ্যে রাখা হতো। কারও সাথে দেখা করার সুযোগ দিতোনা।
সবচেয়ে জরুরী চিকিৎসাটাও দেওয়া হতোনা। নির্যাতনের প্রভাবে তিনি আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারেন নি। প্রায়ই পায়খানার রাস্তা দিয়ে তাজা রক্ত পড়তো। মাঝরাতে ঘুমের মধ্যেই বুক পিঠের ব্যথায় সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠতেন। কারাগারের সঙ্গীরা গরম পানির স্যাঁক দিয়ে তাঁকে শান্ত করতেন।
শেষমেশ একদিন চিকিৎসার অভাবে তিনি এই প্রচন্ড যন্ত্রণার কাছে হার মানলেন। আবুল বাশার ভাই কারাগারের অন্ধকার বিছানায় আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। (শহীদ ইনশাআল্লাহ)।
এই মানুষটার চোখের দিকে তাকালে শুধু দেখা যেত সন্তানের হাঁসির ঝলক, যার জন্য তিনি আজীবন মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। অথচ প্রিয় সন্তানকে তিনি আর কোনদিন কোলে নিয়ে তৃপ্তি করে চুমু দিতে পারেন নি। নিজ চোখে সন্তানের কৈশর-যৌবনের বেড়ে ওঠা দেখে যেতে পারেন নি। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী একাই সন্তানের ভরণপোষণের জন্য লড়ে গেছেন।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো—যে দুটি মামলায় তাঁকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিলো, সেই দুই মামলাতেই আদালত পরবর্তীতে সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে অব্যহতি দিয়েছে। যে মামলায় তিনি বিনা বিচারে আটক হলেন, নির্যাতিত হলেন, পরিবার, মিথ্যা অভিযোগে সামাজিক অবস্থান হারালেন, অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করলেন, জীবনটাও দিলেন; সেই মামলা থেকে তাকে সম্মানের সাথে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ তিনি মুক্ত হয়েছেন; দুনিয়ার সকল অভিযোগ ও মায়া থেকে। কিন্তু থেমে গেছে ঐ নিষ্পাপ শিশুটির জীবন যে আজও জানেনা তার শৈশবকে কে-কারা-কেন পিতৃহীন করে তুললো!
Leave a Reply