লেখকঃ Revan M
ফয়সাল মুস্তফা। লণ্ডনের Secret Intelligence Service (SIS) এর পক্ষ থেকে যাকে Molten Lava কোডনেম দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন রসায়নের ওপর PHD করা একজন মেধাবী বৃটিশ ও বাংলাদেশি নাগরিক। The Guardian এর মতে, বিস্ফোরক নিয়ে রসায়ন বিষয়ক গবেষণা করতে গিয়ে বাল্যকালে তিনি তাঁর হাতের দু’টি আঙুল হারিয়ে বসেন। তারপর ‘৯৬ সালে MI-5 তাঁকে বিস্ফোরক উপাদান সহ আটক করে। অতঃপর তাঁকে ০৪ বছরের জেল দেওয়া হয়। কিন্তু, বৃটিশ আদালত পরবর্তীতে তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। ২০০২ সালে ঐ রায় দেওয়ার সময় তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলেন।
আসলে ফয়সাল মুস্তফা ছিলেন MI-5 ও SIS এর শকুনদের জন্য লোভনীয় টার্গেট। কারণ, বৃটেনের মাটিতে তিনি একজন মুসলিম রসায়নবিদ। পাশাপাশি তাঁর শিকারের প্রতি আগ্রহ ছিল। ফলাফল হিসাবে, তাঁর বাসায় অভিযান চালানো হলে গবেষণার জন্য ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও তাঁর হান্টিং রাইফেলের কার্তুজ পাওয়া যাবে তা ওরা ভালো করেই জানতো। তাঁর বাড়িতে কার্তুজ পাওয়া যাওয়ার খবর ওদের জানবার কারণ হলো, গোলাম মুস্তফাকে শিকারের জন্য ফায়ার আর্মস রাখবার লাইসেন্স স্বয়ং বৃটিশ গভর্নমেন্ট হতেই দেওয়া হয়েছিল।
শিকার ও রসায়নের পাশাপাশি মুস্তফার আরেকটি শখ ছিল। তা হলো, বাংলাদেশে থাকা গরিব ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করা। উক্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ও তাঁর কিছু বন্ধু বাংলাদেশে Green Crescent Charity স্থাপন করেন। যার দেখাশোনার জন্য তাঁকে প্রতিবছর একবার করে দেশে আসতে হতো। বারংবার বন্দি করেও বৃটিশ আদালতে ফয়সালকে ফাঁসাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে UK Intelligence Community তাঁর এই বাৎসরিক বাংলাদেশ ভ্রমণকে সুযোগ হিসাবে চিহ্নিত করে। MI-6 নামে সাধারণভাবে পরিচিতি পাওয়া SIS এর পক্ষ হতে তখন তাঁর ডেজিগনেশন দেওয়া হয় Molten Lava নামে। তারপর, লণ্ডন হতে ঢাকায় RAB এর ওপর তাঁকে তুলে আনবার ও TFI এর হাতে হস্তান্তর করবার আদেশ জারি করা হয়।
মার্চ, ২০০৯ সাল।
বাংলাদেশ ইতিহাসের ভয়াবহতম ধাক্কা হজম করবার ০১ মাসও অতিক্রান্ত হয়নি। মূহুর্তের মাঝে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে Bangladesh Rifles (BDR)। গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে Bangladesh Army। এর মাঝেই RAB এর হাতে Molten Lava বিষয়ক নির্দেশনা আসলে ওরা দেরি না করে ফয়সালকে তুলে আনে। নিজ Charity এর এতিমখানায় তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন JMB এর জন্য Terrorism Training Centre পরিচালনা করছেন মর্মে অভিযোগ তুলে তখন তাঁর তুলে নিয়ে আসাকে বৈধতা দেয় RAB। The Guardian পত্রিকাকে RAB অফিসাররা পরবর্তীতে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেখানে বলা হয় যে, ফয়সালকে তারপর দেরি না করে TFI পরিচালিত কম্পাউণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে TFI এর নির্যাতন বিশেষজ্ঞরা ফয়সালের হাত মাথার ওপরে বেঁধে ফেলে। অতঃপর তাঁকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। টানা ০৬ দিন তিনি ওভাবে ঝুলে ছিলেন। এসময় ঐ অবস্থানে রেখে তাঁর পায়ের পাতায় পেটানো হতো। Electric Shock দেওয়া হতো তাঁকে। অতঃপর উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক আঘাত করা হতো। তবে, মুস্তফার জন্য সামনে যা আসতে চলেছিল, তাঁর তুলনায় এগুলো কিছুই ছিল না।
মূল ভয়াবহতার শুরু হলো ০৬ দিন পর। সেদিন তাঁকে ওরা তাঁর লোহার বার থেকে নামিয়ে ফেলে। তারপর TFI এর করিডোর ধরে তাঁকে নেওয়া হয় Room-1 এ। সেখানে পুনরায় তাঁর চোখ বেঁধে তাঁকে একটি চেয়ারে বসায় ওরা। চেয়ারটির সাথে তাঁকে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। অতঃপর বাংলাদেশি কর্মকর্তারা তাঁকে লণ্ডনের মুসলিমদের মসজিদ East End Mosque & Islamic Centre সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে! মাওলানা কালিম সিদ্দিকীর হাতে গড়া The Muslim Parliament of Great Britain এর বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে থাকে! লণ্ডনের অসহায় নিরপরাধ মুসলিমদের লণ্ডনের আদেশে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে কোমর বেঁধে মাঠে অবতীর্ণ হয় ওরা।
আবার ভেবে বসবেন না যে, প্রশ্ন করবার সময় তাঁকে শুধুমাত্র প্রশ্ন করা হয়েছিল! প্রশ্ন চলাকালীন সময়ে TFI এর টর্চারার টিম তাঁর ডান কাঁধ ও নিতম্বে Drill Machine চালিয়ে ধীরগতিতে ছিদ্র করতে থাকে। The Guardian এর রিপোর্টে সরেজমিন থেকে ফয়সালের শরীরে অনুরূপ নির্যাতনের চিহ্ন দেখার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে।
একদিকে মুস্তফা ফয়সালকে যখন TFI তে নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন আরেকদিকে The Guardian বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক লণ্ডনের আদেশে নিরপরাধ বন্দিদের ওপর নির্যাতনের রেকর্ড নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে তৈরি হয়। খবর পেয়ে লণ্ডন তাঁকে জুন মাসে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের TFI থেকে বের করে বৃটেনে নিয়ে যায়। অতঃপর বাংলাদেশে মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ১৫ বছরের জেল দেওয়া হয়। অতঃপর তাঁকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, তিনি বৃটেনে ফিরে যেতে চান বলে জানতে পারার সাথে সাথে পুলিশের Detective Branch (DB) তাঁকে পুনরায় তুলে নিয়ে আসে। এবার DB এর সদরদপ্তর তাঁকে বলে যে, তুমি HuJI এর সাথে জড়িত! এই অভিযোগ তুলে ওরা তাঁকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে।
Detective Branch এর সিনিয়র অফিসার পরবর্তীতে The Guardian পত্রিকাকে জানায় যে – “আমরা যখন RAB এর কাছে ফয়সাল মুস্তফার ফাইল পাঠানোর জন্য অনুরোধ করি, তখন ওরা আমাদের তাঁর ফাইল পাঠায়। সেটার ওপর ‘MI-6 File’ নামে সিল লাগানো ছিল। আমরা তখন বুঝতে পারি যে, ফয়সালকে প্রথম আটক করা হয়েছিল MI-6 এর নির্দেশে। কিন্তু, পরেরবার আমরা তাঁকে ওদের কথায় তুলি নাই। বরং, সেবার UK High Commission আমাদের তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার আদেশ দেয়। ওরা জানায় যে, আমরা যত বেশি সম্ভব তথ্য চাচ্ছি।”
বাংলাদেশ পুলিশের DB সদরদপ্তরে ফয়সাল মুস্তফার ওপর CIA এর ডেভলপ করা Enhanced Interrogation Technique প্রয়োগ করা হয়। তাঁকে সেখানে চোখ বাঁধা অবস্থায় দীর্ঘসময় অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। তাঁকে সেখানে TFI এর Electric Rotating Chair এর ছবি দেখানো হয়। যেখানে বন্দিকে বসানোর পর ভয়াবহ গতিতে চেয়ার ঘোরানো হয়ে থাকে। তাঁকে DB এর সদরদপ্তরে Waterboard করা হয়। ওয়াটারবোর্ডিংয়ের সময়ে পুলিশ পানির সাথে অস্বাভাবিক কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করতো, যার ফলে শরীরে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি হতো। এসময় তাঁর ডান হাঁটু ভেঙে দেয় ওরা।
দু’সপ্তাহ পর পুলিশ যখন তাঁকে আদালতে হাজির করে, তখন তিনি সূর্যের আলো সহ্য করতে পারছিলেন না। কাঠগড়ায় তিনি অধিকাংশ সময় হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কাটিয়ে দেন। The Guardian পত্রিকার রিপোর্টার বলেন, তাঁদের রিপোর্ট লিখবার সময়কালে মুস্তফা নির্যাতনের ফলে আংশিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আত্মহত্যা করতে চাইতেন। বাংলাদেশের সূর্যসন্তান ও এককালের পাগলাটে ও মেধাবী রসায়নবিদ তখন পরিণত হয়েছিলেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত একজন মানুষে। তিনি মনোযোগ ধরে রাখতে পারতেন না। প্রায়ই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেন। চিকিৎসকেরা এসময় তাঁর মারাত্মক Post Traumatic Stress (PTS) হয়েছে বলে শণাক্ত করেন। পাশাপাশি প্রচণ্ড নির্যাতন ও আঘাতের ফলে তাঁর কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছে বলেও নিরূপণ করেন তাঁরা। অতঃপর পরিবার Renal Failure এর জন্য তাঁর চিকিৎসা শুরু করে।
ফয়সাল মুস্তফারা হলেন বাংলাদেশ। অসংখ্য ফয়সাল মুস্তফা এখনো আজও বাংলাদেশে রয়েছেন। এবং নতুন করে আরো ফয়সাল মুস্তফাদের নির্যাতনের জন্য পরিস্থিতি তৈরি করছে ওরা। আমি এখানে শেষ করে দিলাম। এখন আপনারা যা ভালো বুঝেন করেন। আরেকটি কথা, লণ্ডনের হয়ে ভাড়াটে গুণ্ডার কাজ করে দিলে বাংলাদেশি রাঁধুনিদের ভিসার বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য ঢাকার পক্ষ হতে অনুরোধ করা হয়েছিল। মনে আছে? আজ পর্যন্ত লণ্ডন তার দিকে ভ্রূক্ষেপও করেনি। ঢাকার দাসেরা বিনামূল্যে পদলেহন করে গিয়েছে শুধুমাত্র।
Leave a Reply