Press ESC to close

সাজ্জাদুর রহমান শাওন

(১০ই এপ্রিল’২২)

৮ রামাদান, সবে মাত্র ইফতার করে বের হয়েছি। গন্তব্য স্টারটেক কম্পিউটার এর যার্ম কিনতে যাবো । আমার এক রিলেটিভ আমার জন্য ওয়েট করছেন। মাত্রই বাসা থেকে বের হয়েছি, পেছনে থেকে ডাক আসল, “ভাইই, একটু এদিকে আসেন।” পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনজন ব্যক্তি। কাছে যেতেই জিজ্ঞাসা করল,”নাম শাওন কিনা?” আমি হ্যাঁ বলতেই বলল, চলেন আমাদের সাথে যেতে হবে? আমি বললাম, “আপনারা কারা? আমি কেন যাবো?”

উত্তর আসল আপনার সাথে কিছু কথা আছে । আমি বললাম,”এখানে বলেন?” বলে, এখানে বলা যাবেনা । কথা বলতে বলতে সাদা রঙের এক মাইক্রোবাস হাজির। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাইক্রোবাস থেকে দুইজন অস্ত্রধারী বের হয়ে আসল।

আমি ভয়ে উঠে যেতে বাধ্য হলাম। মাইক্রোবাসে উঠার সাথে সাথে আমার থেকে ফোন, মানিব্যাগ সব কেড়ে নিয়ে, কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলা হয় । সাথে সাথেই গাড়িতে চড়-থাপ্পর, লাথি শুরু হয় যায়। তখনও আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার অপরাধ কোথায়? আমার সাথে কি হতে যাচ্ছে।

পরে তাদের ইচ্ছেমতো গন্তব্য স্থানে নামানো হয়, লিফটে চড়ে এক রুমে আনা হলো। চোখ খোলে দিলো। চোখ খোলতেই দেখতে পাই, আমি কোন এক অফিসের ভেতরে । নানা ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়, “আমি এদের চিনি কিনা ? আমি কোন সংগঠন করি ? তাবলীগে কেন গিয়েছিলাম ? দাড়ি রেখেছি কেন? সাদাকা কোথায় করি?” এসব নানান রকম অদ্ভুত প্রশ্ন । তাদের পছন্দ মত জবাব না পেয়ে , চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। সারারাত মারধর করার পর সেহরীর সময় চোখ বেঁধে লিফটে করে সিটিটিসির সেই বিখ্যাত সাত তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। (অবশ্য তখনও জানতাম না এটা সেই বিখ্যাত সাত তলা)

একা ছোট্ট এক রুমে বন্দী রাখা হয়। সেখানে না ছিল কথা বলার অনুমতি , না ছিল শব্দ করার । এমন নি খাবার পানি চাইলেও অকথ্য ভাষায় গালীগালাজ করা হতো । বাধ্য হয়ে বাথরুমের পঁচা গন্ধ পানি খেয়ে থাকতে হতো। দেয়া হতো নষ্ট পঁচা বাসি খাবার। মাঝে মাঝে তাদের ইচ্ছামত ডেকে এনে বিভিন্ন অপরাধ স্বীকার করার জন্য চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সবচেয়ে বেশি অপমানিত হয়েছে আমার দ্বীন। পড়ার জন্য কোরআন চেয়েছিলাম, এই অপরাধে শোনতে হয়েছে গালিগালাজ। এভাবেই কেটে যায় পুরো একশত দিন। এই ১০০ দিনে না আমি জানতে পেরেছি আমার পরিবার কেমন আছে? না আমার পরিবার জেনেছি আমি কোথায় আছি ? আদৌ বেঁচে আছি কিনা? আমার পরিবার এই ১০০ দিন পাগলের খোঁজেছে । আমার বোন, আমার বাবা এমন কোন থাকা, ডিবি অফিস কিংবা র‍্যাব অফিস বাদ রাখেননি। মর্গে মর্গে খোঁজে ফিরেছে আমাকে। জীবনের দুইটি ইদ কাটিয়েছি সেখানে । আমাকে ছাড়া আমার পরিবারের দূর্বিষহ জীবনে কেটেছে। আমার মাকে হারিয়েছি এক বছরও হয় নি, তার মাথায় আমাকে কিডন্যাপ করে তুলে নেয়া হয় ।

একদিন সন্ধাবেলায় আমাকে ডাকা হয়। বলা হয়, “তোর জন্য সুখবর আছে । তুই যা করছোস চাইলে তোকে ক্রস ফায়ার দেয়া যায় । কিন্তু দিব না। তোকে ছোট খাট একটা মামলা দিব। তুই তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবি। কিন্তু তোর দিক থেকেও আগায়া আসতে হবে। কোর্টে গিয়ে বলবি; তুই জঙ্গি ছিলি, আর তোকে ধরসে ১৬ তারিখ (১৬ জুলাই) । যদি না বলস তোকে ১০ টা মামলা দিবো , তাও অস্ত্র সহ । ক্রস ফায়ার দিবো।”

এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোর্টে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আজ্জওয়াজালের প্ল্যান ছিলো ভিন্ন। গত ১০০দিনের শারীরিক নির্যাতনে শরীরের যে হালত ছিলো, তাই আমার জন্য রহমত স্বরূপ হয়েছে। ম্যাজ্রিট্রেট আমার শারীরিক অবস্থা দেখেই প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,” সত্য করে বলো তোমাকে কবে ধরেছে । তোমার শরীরের এই অবস্থা কেনো?” আমি তাকে সব খুলে বললে সে আমাকে অভয় দেয় যে সমস্যা নাই । এরপর আমাকে যারা মামলা দেয় তাদের ডেকে এনে জবাবদিহিতা করে এবং আমার পরিবার কে জানাতে বলে। দীর্ঘ ১০০ দিন পর আমার পরিবার জানতে পারে আমি জীবিত। এরপরেও তাদের কথা অনুযায়ী মিথ্যা না বলায় ম্যাজিস্ট্রের এর কক্ষ থেকে কোর্টের জেলে নিয়ে যাবার সময় আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া চলমান থাকে ।

এরপর জেলে কেটে যায় দীর্ঘ সময় । কোন প্রমান জবানবন্দী না থাকা সত্বেও জামিন পেতে সময় লাগে ৮ মাস । প্রায় এক বছর পর ২৩ সালের ১ম রামাদানে আমি বেরিয়ে আসি । ৮ম রামাদানের বন্দিত্ব শেষ হয় পরের বছর ১ম রামাদানে । এভাবেই কথিত জঙ্গি নাটকের স্বীকার হতে হয় আমাকে । আমার আর আমার ফ্যামিলির উপর দিয়ে যে ঝড় গিয়েছে, আমি চাইনা তার উপর দিয়ে আর কেও যাক । আমি আজও জানিনা কেন আমাকে তারা বন্দী করেছিল ? কি অপরাধ ছিল আমার?

বি:দ্র: গুম হওয়ার দিনের সিসিটিভি ফুটেজ কমেন্টে এড করা হয়েছে। ফুটেজে হলুদ টিশার্ট পরা ব্যাক্তিটিই আমি। ফুটেজে দেখতে পাওয়া তিনজন হলো এডিসি আহমেদুল ইসলাম, এসি ওবাইন, এসআই বাশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *