Press ESC to close

সিরিয়াল কিলার জিয়াউল আহসান

‘একজন আসামি আছে যার ব্যাপারে তদন্ত করে পেয়েছি সে মাথায় গুলি করে এক হাজার ৩০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। গুম করে মানুষদের আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। তার একটা নেশা ছিল এই গুম ব্যক্তিদের হাত-পা-চোখ বেঁধে নৌকায় করে মাঝ বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যেত। গুলি করে লাশটা নদীতে ফেলত। গুলিটা ভিকটিমের মাথার কাছে নিয়ে করত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম-সেটা কেন? তার জবাব-গুলি করার পর নিহত ব্যক্তির মগজ ও রক্তের গরম ছিটা হাতে লাগলে দারুণ ফিলিংস অনুভব হতো।’

কে এই ভয়ানক খুনি, কে এই সিরিয়াল কিলার? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের এ বক্তব্যের সূত্র ধরে আমার দেশ অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই হিংস্র খুনি বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় নিজের টিম নিয়ে এই খুনগুলো করেছেন তিনি। গুম করা ব্যক্তিকে খুন করতে তিনি বলতেন-‘গলফ করো’।

অর্থাৎ ওকে খুন করো। জিয়াউল আহসান এখন কেরানীগঞ্জ বিশেষ কারাগারের ধলেশ্বরী ভবনে ডিভিশনপ্রাপ্ত সেলে বন্দি আছেন। টেলিফোনে জানতে চাইলে বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সায়েফ উদ্দিন নয়ন জানান, সুনির্দিষ্ট কী অপরাধে তিনি কারাগারে আছেন বলতে পারছি না। তবে তিনি ১৫টি মামলায় (ধারা ৩০২, ৩০৭, ১০৯, ৩২৬) বন্দি আছেন।

এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জিয়াউল আহসানের নৃশংসতার অসংখ্য কাহিনি জানা গেছে। পলাতক শেখ হাসিনা এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের নির্দেশেই বেশি মানুষকে গুম-খুন করেছেন জিয়াউল আহসান। তিনি হাসিনা ও তারিক সিদ্দিকের একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাদের নির্দেশে গুম করে আয়নাঘরে রাখতেন ভিকটিমদের। সেখান থেকে বিভিন্ন কায়দায় খুন করে লাশ গুম করে দেওয়া হতো। জিয়াউল আহসান গুম হওয়া ব্যক্তিদের যমটুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে করে পোস্তগোলা ব্রিজ, কাঞ্চন ব্রিজ কিংবা কাঁচপুর ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে লাশ ফেলে দিতেন শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে। একদিনে একজনকে দিয়ে ১১টি এবং আরেকজনকে দিয়ে ১৩টি খুন করারও রেকর্ড আছে। কখনো মাইক্রোবাসেই ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হতো। এরপর লাশ রেললাইনের ওপর শুইয়ে দিতেন। ট্রেন এসে লাশ দ্বিখণ্ডিত, ত্রিখণ্ডিত করত।

২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে কমলাপুর থেকে টঙ্গি পর্যন্ত ট্রেনে কাটা যত অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ পাওয়া যেত, তা সবই জিয়াউল আহসানের খুন করা। বেশিরভাগ খুন করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে। একটি নির্দিষ্ট নৌকা ছিল। সেই নৌকায় করে যমটুপি পরা ব্যক্তিদের মাঝনদীতে নিয়ে টুপি খুলতেন। চোখ বাঁধা অবস্থায়ই থাকত। মাথার একেবারে কাছে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ও মগজ এসে পড়ত জিয়াউল আহসানের হাতে। তখন তিনি উল্লাস করতেন। কখনো আবার দেখা যেত আগেই হত্যা করা লাশ নৌকায় তুলে নিচে ও উপরে সিমেন্টভর্তি বস্তার সঙ্গে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতেন, যাতে লাশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। হতভাগ্য বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর শেষ পরিণতিও ঘটে জিয়াউলের হাতে।

শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে সীমান্তের ওপারে তাদের হাতে তুলে দেওয়ারও অনেক ঘটনা আছে। সিলেট সীমান্তে এমন ৭ জনকে তুলে দেওয়ার নজির একটি রেকর্ডে উল্লেখ আছে।

এত বড় সিরিয়াল কিলার বিশ্বে নেই

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত ১৫ জন সিরিয়াল কিলারের কাহিনি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ জনকে পর্যন্ত খুন করার ইতিহাস রয়েছে। যিনি তিন বা ততোধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে অস্বাভাবিক মানসিক তৃপ্তিলাভ করেন, পুলিশের ভাষায় সেই ব্যক্তি ‘সিরিয়াল কিলার’। অর্থাৎ, যে ধারাবাহিক বা একের পর এক মানুষ হত্যা করে, তাকেই সিরিয়াল কিলার বলা হয়।।

খুনের নেশায় মত্ত থাকে সিরিয়াল কিলাররা। বিশ্বের কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলারদের ভয়ংকর কাহিনিকে ম্লান করে দিয়েছেন জিয়াউল আহসান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের বক্তব্যে এসেছে, জিয়াউল আহসান ১ হাজার ৩০ জনকে গুম-খুন করেছেন অত্যন্ত নৃশংস বীভৎসতায়। এর আগে বাংলাদেশে সিরিয়াল কিলার হিসেবে খুলনার এরশাদ শিকদার ও চাঁদপুরের রসুখাঁর কাহিনি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *